Taimur Khan — Story and Article

হৃদয়বাউলের অনন্ত যাত্রা
তৈমুর খান
প্রতিটি কবিই বাউল আর বাউলই তো প্রেমিক ।
এই বাউল সত্তাটি বেড়ে ওঠে হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে।
সে গান গায়
অথচ তার কণ্ঠস্বর অস্ফুট।
সে সুর তোলে
অথচ তার সুর বাইরে বেরিয়ে আসে না।
প্রাণের মরমিয়া বোধটি নীরবের ব্যাপ্তি রচনা করে । পার্থিবের কোনও মোহিনীর নূপুর কখনও তাকে আকৃষ্ট করে বইকি। কখনও কারও আঁচল উড়ে যায়। পালতোলা নৌকার ভাটিয়ালি হয়ে যায় প্রবল সুরের রাগিনী। আলতা পরা পায়ের সচকিত হেঁটে যাওয়া এক শূন্যতার দিগন্তে তাকে পৌঁছে দেয়। বৃষ্টি পতনের রাতে মন বড়ো উন্মন হয়ে ঘোরে। কার হাত ধরে মনে মনে ?
মন তো সেই মনই খোঁজে, যাকে পেয়েও হারায়, যাকে হারিয়েও পায়। কবিতা সেই সাধনারই রহস্য হয়ে ফিরে আসে শব্দের নৈঃশাব্দিক অভীপ্সায় ।তাকে বলা যায় না, বর্ণনা করাও যায় না। পার্থিব আলোয় কখনও তার নাম দিই “আলপনা” । তখন কবিতায় লিখি :
আলপনা, হাত ধরো যদি
তোমাকে সঙ্গে নিয়ে পার হই নদী।
এই “যদি” অব্যয়টির শেষ নেই। কতবার ফিরে ফিরে এসে কথার মাঝখানে বসে। “আলপনা” নামের মেয়েটি যুবতী হয়। কখনও তার মুখে অলৌকিক জ্যোৎস্না পড়ে। সে-ও তখন রূপ বদল করে “ঊর্মি” হয়। “ঝরনা” হয়। “কাকলি” হয়। পার্থিব আসক্তির মোহময় প্রতিটি দৃশ্যে যৌবনের সাপ ছোবল দিতে থাকে। রক্তক্ষরণের মহিমময় সময়গুলি পার হতে হতে ভেঙে পড়ে পার্থিবের শরীরী উচ্ছ্বাস। আড়ালে বিরাজ করে সেই নিঃস্বার্থ সমর্পণ। এই সমর্পণে কোনও কার্পণ্য নেই। ছলনা নেই। যা আছে তা স্বপ্নিল উত্তাপের মোহন কৃচ্ছ্রসাধনা। সব সর্বনামেই তখন তাকে ডাকা যায় :
তুমি শুধু তুমি
অনন্ত প্রেমের বিজ্ঞাপন
আবহমান চৈতন্যের সর্বনাম
এই সর্বনাম থেকে যায়। বিশেষ্যগুলি সবাই “রাধা” হয়ে মর্তলীলা সম্পন্ন করে তারপর অনন্ত সর্বনাম হয়। কবিতা তারই হৃদয়পদ । শূন্যতা থেকে মহাশূন্যতায় জীবন পূর্ণ। এই শূন্যতাই প্রেম। সন্তোষ কাল্ওয়ার বলেছেন : “ Life is an empty bottle filled with love.” সুতরাং শূন্যও শূন্য নয়, তা পূর্ণেরই অভিমুখ।
এই বোধই প্রবহমান প্রেম হয়ে জন্ম-জন্মান্তরে ফিরে ফিরে আসে। মানুষ থাকে না, ব্যাক্তি থাকে না, কিন্তু প্রেমের বোধ থেকে যায়। সঞ্চারিত হয় আবহমান অনন্তের হৃদয়ে। এই বাউলকেই ডাকতে হয়, বলতে হয় :
ভাষাহীন এবং ভাষার পথিক
মাঝখানে তার অথই বিলাপ
শূন্যতা এঁকে ফিরে যায়
অস্তিত্ব তবুও কোথাও ফুটে ওঠে
কেঁপে ওঠে মহিমার ভার
ভাষাহীন ভাষার পথিককেও নীরবের পর্যটনে শূন্যতার বিস্তার করে ফিরে যেতে হয়। তবু তো অস্তিত্ব থাকে মানুষের মানবব্যাপ্তির পরিচয়ে, আর সেখানেই এই মহিমা। জ্যাকসন পীয়ারস্ (Jackson Pearce) এই জন্যই বলেছেন : “It is beautiful, it is endless, it is full and yet seems empty. It hurts us.”
এই “hurts”কে নিয়েই মহাসঙ্গমের সন্ধানে স্রষ্টার সাধনা চলতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন :
“আমার যা হবার তা হবে
যে আমাকে কাঁদায় সে কি অমনি ছেড়ে যাবে?”
এখানেও সেই বেদনার অনন্ত ইশতাহারটিই বাউলের মহালোকে জেগে উঠেছে। কবির হৃদয়বাউলকে আমরা চিনতে পেরেছি। আর আমাদের হৃদয়েও এই বাউলের মর্মর প্রজ্ঞাটি প্রতিনিয়ত এক ক্ষত ও ক্ষরণে শব্দের বারান্দা নির্মাণ করে চলেছে। যেখানে দাঁড়িয়ে আমরা মহাকালের তরঙ্গে নিজেদের ভাসাবার অপেক্ষায় আছি।
#storyandarticle