TAIMUR KHAN
আত্মবিষাদের নিরন্তর অভিযাপন
তৈমুর খান
কবিতা লেখা যে জীবনকে লেখা তা আর একবার বুঝিয়ে দিলেন কবি অশোক ঘোষ। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অন্য এক আঁধার’(২০২১) কাব্যটিতে স্মৃতিব্যঞ্জনার মর্মরিত আলোকমালা সাজিয়েছেন তিনি।
জন্ম থেকে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া পথপরিক্রমায় কত বাঁক, কত অভিঘাত, কত হাতছানি, কত আকুতি, কত স্বপ্ন একে একে সবকিছুই তুলে এনেছেন এই বিকেলবেলার একান্ত নিভৃতে।
না কোনো গরিমা নয়, অহংকার নয়, আত্মজীবনীর প্রচ্ছদে কিছু ঝিকিমিকি আলোর ছটা — আজ যা কবির কাছে ‘অবাস্তব ভাবনা’ হিসেবেই উল্লিখিত হয়েছে। জীবনের হিসেবের খাতা শূন্য। বেঁচে থাকাও উদ্দেশ্যহীন।
কী পেলাম আর কী দিলাম, আর কী পেতে চেয়েছিলাম — এসব হিসেব করাও এক ভ্রান্তির মরীচিকায় নিজেকে সমর্পণ করা। কবি এ কথা জানেন বলেই কাব্য শুরুর মুহূর্তেই তিনি বলে দিয়েছেন:
‘আমিও পথহারা এক পথিক’
‘আমিও’ শব্দটিতে আমরা বুঝে নিতে পারি সমগ্র মানবজগৎ-ই পথহারা। এই দার্শনিক চেতনা জীবনের অন্তিমলগ্নে এক সত্যসন্ধানী মনীষীকেই আমাদের সামনে উপস্থিত হতে দেখি।
২৮ টি কবিতায় কবি কোনো নামকরণ করেননি। সবগুলোই একই দ্রাঘিমায় জীবনের বিভিন্ন স্তরগুলিকে চিহ্নিত করে। বাল্যকাল থেকে কৈশোর-যৌবন তারপর মধ্যবয়স উপলব্ধির স্তরগুলি একে একে উঠে আসে। মায়া-মোহের আবরণ ছিন্ন হতে থাকে। শুরু হয় ‘নিজের সাথে নিজেরই যুদ্ধ’। কত আপনজন একে একে সবাই কেটে পড়ে। কবি লিখেছেন:
‘সিরাজুলদা বা মোহিনীদার ফোনও আসে না’
কবি জানেন সিরাজুলদা অর্থাৎ সিরাজুল ইসলাম তিনি দুনিয়া থেকেই বিদায় নিয়েছেন। মোহিনীদা তো প্রায় জীবন্মৃত। কবি আরও একা হয়ে পড়েছেন:
‘এই শব্দহীন অন্ধকারের মাঝে হেঁটে চলা
বড়ো একা পথ চলা
পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে…’
আমরা প্রত্যেকেই পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে হেঁটে চলেছি অবিরল। কেউ আগে পৌঁছাচ্ছে, কেউ পরে পৌঁছাবে। কবি মুকুল, অসিত, নারান, আলোক, মণীন্দ্র, সুমিতেশ আরও কতজন আজ স্মৃতি হয়ে আছে।
কবির সামনেও এই কালো অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে। সঙ্গে কেউ নেই। শুধু নিজেকেই নিজের নাম ধরে ডাকা। জীবনের আলো যখন খসে খসে পড়ছে তখন এইরকমই বোধ হয়:
‘দিনগুলো ছোট হতে হতে
কখন যে পেরিয়ে যায়
স্মৃতির আঙিনায় আলো-ছায়ার খেলা’
এই আলোছায়ার খেলায় জীবনের ধূসর মগ্নতা ফিরে আসে যা মহাজীবনের দিকেই ইঙ্গিত করে। সামনে ধুধু প্রান্তর। শূন্যতার দিগ্বলয়। বারবার নিজের কাছেই কবি ফিরে আসেন। নিজেকেই প্রশ্ন করেন: আমি কে?
কিন্তু উত্তর কি পান কবি?
হ্যাঁ উত্তর পান:
‘চোখ খুলতে দেখি অন্ধকার
আমার শব্দ
আমারই নাম ধরে ডাকছে
অশোক অশোক…’
এই অন্ধকার আত্মকেন্দ্রিক যা উপলব্ধি করা যায়। এই অন্ধকার আত্মবিষাদের নিরন্তর অভিযাপন। এই অন্ধকার জীবনের অন্তিম অভিলাষ। মৃত্যুচেতনার গভীর নিদর্শ হয়েই প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটি মানবজীবনে। শেক্সপিয়র এই কারণেই বলেছেন :
All that live must die, passing through nature to eternity.
(William Shakespeare (1564–1616) English playwright and poet) অর্থাৎ যাঁরা বেঁচে আছেন তাঁদের অবশ্যই মরতে হবে, প্রকৃতির মধ্য দিয়ে অনন্তকাল ধরে। কবি অশোক ঘোষ(১৯৫৪) অবেলার শেষ রোদ্দুরে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই মৃত্যুকেই অভিবাদন জানিয়েছেন। সম্পূর্ণরূপে এটি একটি মৃত্যু চেতনার কাব্য।
অন্য এক আঁধার: অশোক ঘোষ, শব্দরঙ হাউস, কাঁথি, পূর্ব মেদিনীপুর, মূল্য: ৫০ টাকা, প্রচ্ছদ: অর্পণ।