TAIMUR KHAN

একাদশ অশ্বারোহীর নিবিষ্ট উন্মেষ
তৈমুর খান
অনির্বাণ ভারতীয় সম্পাদিত এগারো জন কবির এক ফরমা করে এগারোটি কাব্য নিয়ে এক মলাটে বৃহৎ কাব্য সংকলন ‘দিগন্তরেখার নীচে’(২০২১) প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা কবিতার কাব্য সংকলনের অভাব নেই, কিন্তু মনের মতো কাব্য সংকলনের অবশ্যই অভাব আছে। এই কাব্য সংকলনটি সেই অভাব পূরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেই কবিতার বৈচিত্র্যময়তা, বহুমুখীনতা এবং সাম্প্রতিক বাঁকবদলের সৃষ্টির রহস্যময়তাকে অনুধাবন করেই ৭০ থেকে ৯০ দশক পর্যন্ত কবিদের স্থান দিয়েছে। এই ১১ জন কবিই মূলস্রোতের কবি নন। তাঁরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে আত্মমগ্ন সৃজনশীলতায় কাব্য চর্চা করে চলেছেন। আমরা তাঁদের কবিতার বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করার চেষ্টা করব।
সংকলনের প্রথম কবি সন্তোষকুমার মাজী(১৯৪৯), তাঁর কাব্যের নাম ‘শুধু জেগে থাকি’। কবিতায় সন্তোষকুমার মাজী নিজ সত্তাকে বিস্তৃত করার মধ্যে দিয়ে মানবজন্মের সম্মোহনকে জাগিয়ে তুলেছেন। মানবজন্ম খণ্ডিত, সীমিত, অসম্পূর্ণ। কবি তা উপলব্ধি করেই লিখেছেন:
“আমিতো সংকীর্ণ আছি সময়ের স্রোতে
আমিতো আবিষ্ট আছি মাটি-ঘ্রাণ-মেখে”
কবির আবিষ্ট হবার কারণও আমরা জানতে পারি:
“আমি তো ভুলেই গেছি পিসিমার ভাষা
আমি তো ভুলেই গেছি অধর দংশন
আমি তো ভুলেই গেছি ব্যথা-ভরা-সুখ”
এক রোমান্টিক বেদনাকে বহন করেই তিনি মগ্নমানুষের ছায়া চান। এই মগ্নমানুষ প্রকৃতির মতো অনন্ত দিশারী হয়ে উঠবে। কবির বিচরণ পৃথিবী ছাড়িয়ে ভিন্ন গ্রহের জগতেও পাড়ি দেয়। আবার ভিন্ন গ্রহ থেকে পৃথিবীকেও দেখেন। জ্যোৎস্না, দিব্যলোক একাকার হয়ে যায় সত্তায়। মহাজাগতিক প্রশ্রয় রচনা করে চলেন এভাবেই। ভূগোল-ইতিহাস থেকে পুরাণ-দর্শনেও জন্মান্তরের মহিমা অনুভব করেন। কবিতাগুলি সেই মহাজীবনেরই অন্বেষণ করে চলে। তখন শরীর নয়, এক বোধের তীব্র শক্তি কবিকে মহাপর্যটনে টেনে নিয়ে যায়:
“সময়ের মহারণ্য থেকে
ফিরি শূন্যে, মহাশূন্যে
পুনর্বার ফিরি
মনে কিংবা জাগ্রত স্বপনে…”
শব্দের বিষাদ-যোগ থেকে আত্মাকে মুক্ত করে মহাপ্রজ্ঞার নান্দনিকে নিজেকে প্রবল ভাবে ভাসিয়ে দেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর শব্দকে শতাব্দীর ভিক্ষাপাত্র মনে হয়েছে। কবি সন্দেহাতীত হয়েই ঘোষণা করেছেন:
“আত্মাকে জেনেছি বলে পরমাত্মা ছাড়া সকলই অসার!”
ব্রহ্ম জীবনের এই সম্মেলনেই প্রতিটি জীবজন্মের সার্থকতা। কবি সেই পথেই অগ্রসর হয়েছেন।
সংকলনের দ্বিতীয় কবি অনিমেষ গুপ্ত(১৯৫১), তাঁর কাব্যের নাম ‘এভাবে যেতে নেই’। অনিমেষ গুপ্ত বরাবরই ভিন্ন ধারার কবি। তাঁর কবিতায় বিমূর্ত চেতনা’র নির্মিতি লক্ষ করা যায়। বাস্তবের কোনো ছবি নেই। বিবৃতিও নেই। একান্ত আত্মগত উপলব্ধিকে তিনি লক্ষ্যেও পৌঁছাতে চান না। এক মুক্ত দিশার তীব্র গতি পায় তার ব্যবহৃত শব্দগুলি। ইমেজও ভেঙে যায়। কবি বলেন:
“জটিল সব স্নায়ুতন্ত্রী খুলে যাচ্ছে পরতে পরতে”
স্নায়ুতন্ত্রীর জটিলতা খুলে গেলে তো মুক্তকচ্ছ উপলব্ধির জগৎ। একান্ত নিজস্ব নিয়মেই অটোমেটিক রাইটিং হয়ে যায়। কিন্তু কবি তো সজাগ। নিজেকেও সেভাবেই তৈরি করেন:
“থাকতে-থাকতে
অন্ধকার সয়ে গেছে কবে
মন এক সাজানো নরম প্রসাধনী
ভেবেছিলাম আসবে যখন
নিশি লাগবে
নিশি ডাকবে বুকে…
এল যখন চোখ ধাঁধিয়ে
অন্ধ করে এল।”
এই অন্ধকারে অন্ধ জীবনের কোনো প্রচ্ছায়া নেই। প্রতীয়মানতা নেই। তবু মন আছে। মনের সাজানো নরম প্রসাধনী আছে। মনের মাঝে কে এলো তবে?
এল তেজস্বী দীপ্তির আধার, যা আরও অন্ধ করে দিল। এই অন্ধ করা লিবিডোতেই বিমূর্ত কবিতা রচিত হলো। বিমূর্তবাদের অন্যতম প্রবক্তা রাশিয়ান চিত্রশিল্পী শিল্পতত্ত্ববিদ কন্ডিনস্কি ওয়াসিলি বলেছেন: “Form itself, even if completely abstract … has its own inner sound.”
(Wassily Kandinsky)
অর্থাৎ সম্পূর্ণ বিমূর্ত হলেও তা নিজেই একটি ফর্ম।এর নিজস্ব একটি অভ্যন্তরীণ স্বর আছে। সমস্ত কবিতা জুড়েই এই বিমূর্ত শিল্পের স্বর আমরা শুনতে পাই। মগ্ন উদাসীন থেকে সাঁই পর্ব জুড়ে দূরের গন্ধ, বাগানবাড়ি পুকুরের একাকিত্ব আনচান এবং শীত পেরিয়ে দুপুরগুলি অব্যর্থ চুপ সব কিছুর মধ্যেই সেই স্বরকেই শুনতে পাই। যে স্বরের কথা আর একজন শিল্পী বলেছেন: “Art has a voice — let it speak.” (Rochelle Carr) অর্থাৎ শিল্পেরও কণ্ঠস্বর আছে, শিল্পী জানেন তার ভাষা। এই কবির লেখাতে পাই:
“শীত পেরিয়ে যেখানে
দুপুরগুলো অব্যর্থ চুপ
তার পাশে আমাদের অনন্তের ঘর।”
এই অনন্তের ঘরেই উত্তরণ ঘটেছে কবির।
সংকলনের তৃতীয় কবি অমিয়কুমার সেনগুপ্ত(১৯৫৩), তাঁর কাব্যের নাম ‘শেকড়ে দাঁড়াও বৃক্ষ’। অমিয়কুমার সেনগুপ্তের কবিতা পড়ে আমরা বড় হয়েছি। প্রতিটি কবিতাতেই শিল্প-সুষমামণ্ডিত ছন্দের ভেতর দার্শনিক বোধের তীব্র শ্লেষে এক মেধাবী উত্তরণ আছে। কোথাও প্রশ্নে, কোথাও বিস্ময়ে তিনি তাঁর ভাবকে দাঁড় করান। জীবনের ধূসরতা থেকে প্রদীপ্ত উন্মুখতাও উঠে আসে। সময়কে অনুবাদ করতে গিয়ে লেখেন:
“শহর জুড়ে রৌদ্রে ওড়ে জ্বর
তার বীজাণু জীবন্ত ভাইরাস
আতঙ্কময় বাতাস কলস্বর —
শখ করে কে চাষ করে সন্ত্রাস!”
কবিতার শেষে লেখেন:
“জঞ্জালই এই জীবনে সঞ্চয়…”
পথের মাঝে আমাদের পথ নেই। জলের মাঝে জল নেই। মনের মাঝে মন নেই। সেই মানুষ আমরা যাকে ‘হলো-ম্যান’ বলা চলে। যার সমস্ত ফাঁকা, এক বিমূঢ়তার আবেশে পথ চলে। জীবনের এই শূন্যতাকে, অস্তিত্ব ক্ষয়কে সঙ্গে নিয়েই বেঁচে থাকা। এক অপমানকর এই বাঁচা। কবির কথায়:
“বাঁচার ভেতর পরপুরুষের চোখে
সন্দেহ তাও গন্ধ ধরে রাখে,
মন্দ নারীর ঠোঁটের চুমুর রঙে
সময় আসে দৌড়ে; শাবাশ! আমি
শীতদুপুরেও দরদরিয়ে ঘামি…”
এই ঘেমে যাওয়াতেও আমাদের বিনাশের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কবি বলেন:
“আসলে,
ছায়াই মানুষের অস্তিত্বের পরিচায়ক।”
অব্যর্থ সত্যের সন্ধানে জীবনের নিগূঢ় পরিমাপকে তিনি কবিতায় তাৎপর্যমণ্ডিত করে তুলেছেন।
সংকলনের চতুর্থ কবি ভবেশ বসু(১৯৫৩), তাঁর কাব্যের নাম ‘ব্রহ্মকমল’। ভবেশ বসুর কবিতার মধ্যে অদ্ভুত এক জাদু আছে। যে জীবন সমাচারে আমাদের ভুবন ভরা আছে তারই প্রতিধ্বনি শুনতে পাই। মূল্যবোধের প্রাচীন ও প্রগাঢ় তত্ত্বটি আমাদের দৃষ্টিগোচর করান বলেই আমাদের সামনে তুলে ধরেন:
“দেশের মানচিত্র ছিঁড়ে নিয়ে যাচ্ছে অধিক ব্যক্তি,
দুহাতে বুক চেপে ঠকঠক কাঁপছে একজন, তুমি দেখেছ কি
— এত তৃষ্ণা তোমার — জানো না
আঁতুড় ঘুরে দেখা নিষেধ
প্রেমে লেগে আছে রক্ত,সেই রক্ত-ফসলের দাম এখনও শোধ হয়নি, এইযে শিশির —
মায়ের ঋতুস্রাব, পদ্মপাতা গোলাপ ও ধানফুলের মুখে মুখে জমা, কত যুগ গেল
— কত শিশু মহাসাগরের কাছে এসে স্বর্ণমুদ্রা খুঁজে নিল,
মায়ের কপালে সেই দুঃখফোঁটা — শঙ্খ-সাগরে সেই স্বর্গীয় খণ্ড এখনও রঙে লাল।”
তখনই আমাদের মেরুদণ্ড ঠান্ডা হয়ে যায়। নিজেদের কাপুরুষোচিত সত্তাটিকে চিনতে পারি। তাঁর কবিতায় আর্য ঋষির দীপ্তি,যৌবনের মগ্ন ও মন্দিরা যেমন বেজে ওঠে, তেমনি জ্ঞানবৃক্ষের স্থান দখল করে অজ্ঞান বৃক্ষ। ব্রহ্ম শরীর থেকে নেমে আসে যাবতীয় সংরাগ। পুরাণ প্রসঙ্গগুলি আধুনিক জীবন জিজ্ঞাসায় রূপ বদল করে। চরিত্রগুলিও ঘামসিক্ত ধূলি-ধূসর মানবের রূপ পায়। কোথাও এক ফোঁটা দৈব নেই। যা আছে তার জীবনের মর্মরিত যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ের উত্তাপ। ব্রহ্মময় জীবনের বিস্তারে কবিও মিশে গেছেন:
“আমি ভাঙছি, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ব তোমাদেরই ঘর বৈঠকখানায়”।
দীর্ঘ পংক্তির গদ্য কবিতায় যে বাস্তবতার কংক্রিট কবি নির্মাণ করেছেন তা দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতোই মানবের পরাকাষ্ঠা হয়ে বিরাজ করছে।
সংকলনের পঞ্চম কবি অমর চক্রবর্তী(১৯৫৭), তাঁর কাব্যের নাম ‘আঙুল ছুঁয়ে যাও অভিমানী’। অমর চক্রবর্তী সামাজিক অবক্ষয়, প্রতারণা, ধর্ষণ, শোষণ-পীড়ন, অমানবিকতা থেকে মুক্তি চান। কিন্তু সেই মুক্তি কীভাবে সম্ভব?
আধ্যাত্মিক প্রশ্রয়ে মহাসাধকের পথেই তখন তিনি নিজেকে চালিত করেন:
“ভাঙা বেড়াগুলি আমি বেঁধে দিতে চাই
ভালোবাসার তার দিয়ে
ওপাশ থেকে তুই বাঁধন ঘুরিয়ে দে মহামায়া।”
রামপ্রসাদের শক্তি সাধনার পথেই হয়তো মহামায়া এসে মানবিক পৃথিবী রচনা করবে। কিন্তু যে অসুস্থ জীবন কবি বহন করেন, যে শোক ও শূন্যতায় পথপরিক্রমা করেন তা থেকে কিছুতেই নিজেকে বাঁচাতে পারেন না। জটিল এই সংসারে আর পাঁচটা মানুষের মতো কবির বাঁচা নয়। তখন নিজস্ব এক সংসারের বৃত্ত তৈরি করেন:
“এইসব দেখে-শুনে আমি এক শহর বানাতে থাকি
সেখানে অমিত উৎসাহে স্বপ্নে-মমতায়
ছাদের উপরে চাঁদ আর ছাদের ওপরে ছাদ
থাকবে ঐশী গাছপালা অস্থির কথামালা
ঈশ্বরের চুম্বন একরাশ।”
সব কবিতাগুলিতেই জীবনের এক মগ্নতা বিরাজ করে। কবি দার্শনিক চেতনায় নিজেকে চালিত করেন। কবি জানেন: বাহিরের জৌলুস ঐশ্বর্য অন্তঃসারশূন্য:
“সংসার থেকে আলো কমে গেলে
প্রসাধন তাকে কি করে বাঁচাবে”
মৃত্যু-লেখা ভাতের ঘ্রাণে আধ্যাত্মিকতার জাগরণ টের পান। মানবজমিনের রুক্ষতাকে নিয়েই জীবনের পথে কবির সংরাগ রচনা।
সংকলনের ষষ্ঠ কবি নীলাঞ্জন কুমার(১৯৫৯), তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘গড়ে নাও নিজস্ব পৃথিবী’। নীলাঞ্জন কুমারের নিজস্ব পৃথিবী গড়ার সম্মোহনে আত্মস্থিত এক প্রজ্ঞার দেখা পাই, যাতে নিজস্ব বাস্তবতাকেই তিনি প্রাণের গরিমায় রাঙিয়ে তুলেছেন। এই নিজে গড়া বাস্তবতায় কিউবিজম ধারার কবিতার প্রভাব আছে। কিউবিস্ট কবিদের বক্তব্য হল: “The Cubist Poets in Paris: An Anthology…
Cubism is… a picture for its own sake. Literary Cubism does the same thing in literature, using reality merely as a means and not as an end.” (Max Jacob)
প্যারিসের কিউবিস্ট পোয়েটস: একটি অ্যানথোলজি থেকে জানা যায়, কিউবিজম … নিজের স্বার্থেই একটি ছবি। সাহিত্যেও একই কাজ করে। বাস্তবতাকে একটি উপায় হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু শেষ হিসেবে নয়। নীলাঞ্জন কুমার এই বাস্তবতাকেই উপায় হিসেবে উপস্থিত করেছেন:
“শূন্যের ভেতর বাড়তি শূন্য
হতাশা শেখায়
কিছুতে শান্তিতে থাকতে দেয় না।”
এই শান্তির জন্য যে বাস্তবতার দরকার তাকে নিয়ে আসতে চান, কিন্তু তা সম্ভব হয় না। সেই বাস্তবতা ছিন্ন হয়ে যায়। কবিও লক্ষ্যভ্রষ্ট হন:
“শিব গড়তে গিয়ে সারাক্ষণ বাঁদর
গড়ে চলেছি
কেউ এগিয়ে এসে শুধরে দিচ্ছে না।”
স্বাভাবিকভাবেই তখন আত্মদ্রোহ সৃষ্টি হয়। কবির অভিজ্ঞতা:
“সমস্ত আস্ফালন মনে মনে
জীবনকে খুশি করা গেল না।”
তখন নিজে নিজেই অট্টহাসি হেসে আরও সত্যের খোঁজ করা শুরু করেন। সময়ের যন্ত্রণা পীড়িত অভিঘাত কবিকে অস্থির করে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে পরিযায়ী শ্রমিক এর মৃত্যু। রেললাইনে ছিটকে পড়ে থাকা রুটির দৃশ্য। এই বাস্তবতা থেকেই কবি তাঁর নিজস্ব বাস্তবতার সন্ধান করেন, আর তখনই কিউবিজম কবিতায় পৌঁছে যান।
সংকলনের সপ্তম কবি আশিস চৌধুরী(১৯৫৯), তাঁর কাব্যের নাম ‘তোমাকে দিলাম’। আশিস চৌধুরী সমসাময়িক অবক্ষয়, অন্তর্ঘাত, অবিশ্বাসকেই কবিতায় রূপ দিয়েছেন। তাঁর বেশিরভাগ কবিতাই রূপক কবিতা। রূপক ও সংকেতের মধ্য দিয়েই তিনি সময়কে উচ্চারণ করেছেন:
“সব সাপ বিষধর না হলেও
লাল নীল সাদা সবুজ গেরুয়া রঙের সাপেরা
কিন্তু বিষধরই”
প্রকৃত সাপেরা বিষধর না হলেও রূপকের সাপেরা যে মানুষ এবং মানুষই শ্রেষ্ঠ বিষধর তা জানিয়ে দিয়েছেন। যারা একদিন মুখোশের কথা বলেছে, সমাজে তারাই আজ মুখোশধারী। এই সময়ের রাজনৈতিক হিংস্রতা, নতুন নাগরিকত্ব আইন, বিচ্ছিন্নতাবাদ সবকিছুই কবিতায় প্রভাব ফেলেছে। প্রকৃত উদ্বাস্তুরা এসে দেশবাসীকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছে। গণতন্ত্র একটি প্রহসনে পরিণত হয়েছে। মানবহিতৈষীর নামে মানব ধ্বংস শুরু হয়েছে। কবি দার্শনিক হয়ে উঠেছেন:
“এ জীবন এক ফুটো কলশি
কিছুতেই পূর্ণ হওয়ার নয়
শুধু কথার কলশি উপচে পড়ে
সম্পর্কের ভেতরেও হাজার সেলাই
শুধু মধুর স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা”
সব কবিতাগুলিতেই কবির বাস্তব অভিজ্ঞতা এবং দুঃখ-দহনের নিভৃতি এসে ভিড় করেছে।
সংকলনের অষ্টম কবি সৌমেন সাউ(১৯৬৫), তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘একশো আট নীল পদ্ম’। সৌমেন সাউ আমাদের বলে দেন, পৃথিবীতে আমরা সবাই একা। মৃত্যুর আগেও একা, মৃত্যুর পরেও একা। সুতরাং আমরা নিজেই নিজের অভিভাবক। নিজেই নিজেকে পরামর্শ দিই। নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াই। শূন্য আসলে কিছু নয়, শূন্য একটি মনের রোগ।
এই মনকেই আবার বিস্তৃত করা যায়। সময়কাল, ব্যক্তি ও বস্তুর মধ্যে চালনা করা যায়। ভৌগোলিক সীমানাকেও উল্লঙ্ঘন করা যায়। মানবস্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়া যায়। উদ্ভিজ্জ প্রকৃতি ইতিহাস ভূগোল বর্ণপরিচয়েও নিজেকে খুঁজে পাওয়া যায়। এই কারণেই কবির উপলব্ধি:
“তুমি তাকে আমার মতো করে ভেঙে ভেঙে
একশো আট ভাগে ভাগ করে চেঁচিয়ে উঠেছ
তারপর সবাইকে ডেকে দেখিয়েছ
এভাবেও জীবনকে সাজিয়ে রাখা যায়
এভাবেও জীবনকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া যায়।”
জীবনকে এই ভাবেই মুক্ত জীবনে ঠেলে দিতে চেয়েছেন। আরোগ্য আর স্নেহের বন্ধনে সম্পর্কগুলি গুছিয়ে নিতে বলেছেন। দুঃখ-কষ্টগুলি সহিষ্ণু তাপে সেঁকে নিতে বলেছেন। চোখের তারায় ফুটে ওঠে হেমন্তের ফসলের একশো আটটা নীলপদ্ম। আর এই-ইতো জীবনের আয়োজন।
সংকলনের নবম কবি অপর্ণা দেওঘরিয়া(১৯৬৬), তাঁর কাব্যের নাম ‘আলো জ্বেলে বসে আছি’। অপর্ণা দেওঘরিয়া সত্যসন্ধানী জীবনমন্থনের তলানি থেকে তাঁর উপলব্ধির রসদ সংগ্রহ করেছেন। ‘স্বপ্নবিধ্বস্ত স্মৃতি কিংবা বিস্ময়কর গুপ্তধনের সন্ধানে’ সীমাহীন শুভ্রতায় বৃষ্টির কবি হিসেবে বেঁচে উঠতে চেয়েছেন। তাঁর কবিতায় জীবনবাদের প্রতিধ্বনি শুনতে পেয়েছি। প্রেম-সুধার অবিরল উৎস ধারায় আমাদের ভিজিয়ে দিয়েছেন:
“যদি আসো, অভিমানে মেখে নেব মধুলোভী স্পৃহা
অন্তরে বাজায় বাঁশি, স্বপ্নের তানপুরা প্রিয়
উথালপাতাল বুকে, হায় প্রেম সুন্দর তুমি
যদি আসো মোহময় বিশ্বাসে সুধাটুকু দিয়ো।”
প্রেমের এই অপেক্ষা আবহমান প্রতিটি হৃদয়ে জাগরুক হয়ে থাকে। কবি সেই হৃদয়ের ঠিকানা খুঁজেছেন। কবির পৃথিবী সুন্দর ফুলে ফুলে সাজানো, স্বপ্নের মোড়কে মোড়া। চিরসবুজ। চির সতেজ। এখানে শত আঘাত এলেও নিজেকে বিক্ষিপ্ত মনে হয় না। ভালোবাসার জলসা ঘরে মুগ্ধতায় সোহাগে আনন্দে মেতে ওঠা যায়।
সংকলনের দশম কবি তুলসীদাস ভট্টাচার্য(১৯৬৬), তাঁর কাব্যগ্রন্থের নাম ‘পাথরের তরবারি’। তুলসীদাস ভট্টাচার্য মানবসভ্যতার আদিম প্রাগৈতিহাসিক মুহূর্তকে স্মরণ করেছেন। কবিতা সেই সৃষ্টিউৎসের প্রবৃত্তিকেই বহন করে নিয়ে চলেছে। কবির উপলব্ধি:
“চারিদিকে নীল জল
লোনা বাতাস
লোনা রক্ত
পুরুষের কটিদেশ খুঁড়ে বের করে
জড়োয়া হাড় বিছানো সঙ্গমের বেলাভূমি।”
এই প্রবৃত্তির মৃত্যু নেই। সময়ের পরিবর্তনে তা নানাভাবে অন্তরাল হয়ে আছে। মানুষ মৌল আদিমতাকেই বহন করে নিয়ে চলেছে। সাজসজ্জা অথবা রূপসজ্জা পাল্টালেও এই আদিমতা লক্ষ করার মতো:
“ঘুনসির নীচে নেশাতুর চোখে
সোনালি সাপের উত্থিত ফণা।”
এই ফণা সবসময়ই দেখা যায় না, অথচ তা আছে। কবি বিশ্বাস করেন ‘কবিতার কাছাকাছি থাকাটাই জীবন’। সুতরাং এই জীবনই কবিতা। জীবনের অন্ধত্বই জীবনকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চালিত করে কবিতায়। সুতরাং মানবজন্মের সার-কথাই কবি লিখে চলেন। অশ্লীলতা নয়, জীবনের অংশই বরং প্রকট হয়ে ওঠে। তাই কবিতায় বারবার ‘সঙ্গম’ শব্দটি ফিরে আসে। প্রকৃতিও যেন এই আয়োজনে ব্যস্ত। রাত্রির আধারে বহুমুখী ক্রিয়ায় তা সম্পন্ন হয়।
সংকলনের একাদশ কবি চৈতালি ধরিত্রীকন্যা(১৯৬৯), তাঁর কাব্যের নাম ‘অর্গানে তোলা দিনলিপি’। চৈতালি ধরিত্রীকন্যা এক মানবিক দায় থেকেই তাঁর কবিতায় মর্মরিত আলো-আঁধারের যাপন লিপিবদ্ধ করেন। সময়ের স্বরলিপি থেকে খুঁজে নেন জীবনের গতি কত দ্রুত এগিয়ে চলেছে সমাপ্তির দিকে। তাই প্রবহমান জীবনের চিহ্নগুলি সাজিয়ে রাখেন শব্দে এবং শব্দের অন্তরালে। কবি লেখেন:
“আমার মধ্যে আমাকে চাষ করে চলেছি
আজ মাটি আমাকে মাফ করেছে
ঝরনা আমাকে আর হিংসা করে না।”
‘আমি’ ও ‘আমার’ আত্মবাচক সর্বনামে নিজের মধ্যে বহুকে ধারণ করেই নারীবাদী চেতনাতেও কবি সচেতন হয়েছেন:
“বিকিনি থেকে বোরখা
ঘোমটা থেকে ঘাগরা
স্বাধীনতা কাকে বলে মা?”
নারী যে পুরুষশাসিত সমাজে স্বাধীন নয়, তা তাঁর বিদ্রোহিণী সত্তায় প্রতিফলিত হয়েছে। তবু নিজেকে গরবিনি ভাবতে পারেন:
“শিল্প যখন অবহেলা শিল্প মায়াহীন
আমার ভিতর জন্মেছিল বোতল আলাদিন।”
অর্থাৎ নারীর মাতৃসত্তা সমস্ত শক্তিসত্তারই উৎসভূমি। শিল্পও সেখান থেকেই উদ্গত। আবার শিল্পের মধ্যেই জীবন বড় হয়ে ওঠে। জীবনের দীপ্তি ও দৃঢ়তা নির্ণীত হয়। কবিতার ক্ষেত্রে সেই বৈপ্লবিক ছায়াই প্রদর্শিত হয়েছে। ভেঙে ফেলেছেন আঙ্গিক গঠন এবং কথন ভঙ্গিও। আপন অস্তিত্বের সাবলীল প্রয়োগে শিল্পকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন।
একাদশ অশ্বারোহীর এই নিবিষ্ট উচ্চারণ সাহিত্যের যুদ্ধভূমিতে এক নতুন দিগন্তের উন্মেষ বলা যায়। সময় ও ব্যক্তিনিরীক্ষায় কবিতাগুলি একটা মূল্যবান সংযোজন হিসেবে উল্লিখিত হবে সাহিত্যের ইতিহাসে।
দিগন্ত রেখার নীচে: অনির্বাণ ভারতীয় সম্পাদিত, চালচিত্র প্রকাশন চিচড়া, ঝাড়গ্রাম, পশ্চিমবঙ্গ, মূল্য:২৫০ টাকা।
