যতটুকু গান ততটুকু বেঁচে থাকা — তৈমুর খান

আশিস মিশ্র বিশ্বাস করেন কবিতা এবং হৃদয় কখনও মরে না। তিনি বলেন: ‘যতটুকু গান ততটুকু বেঁচে আছি।’ বেঁচে থাকার সুর গান। আর গান-ই হলো জীবন। কিটস বলেছেন:’There is nothing stable in the world; uproar’s your only music.’ অর্থাৎ পৃথিবীতে স্থিতিশীল কিছু নেই; হৈ চৈ-ই তোমার একমাত্র সঙ্গীত। সুতরাং মৃত্যুর পয়ারকে অগ্রাহ্য করেই আবহমান অনন্তের উত্তাপে জেগে উঠেছেন কবি আশিস মিশ্র।
সম্প্রতি প্রকাশিত আশিস মিশ্রের একাদশতম কাব্যগ্রন্থ ‘সারাদিনের তৃষা’(২০২১) পাঠ করতে গিয়ে উপরোক্ত কথাটি মনে হলো। কবিতার নানা বাঁক অস্পষ্টতা জটিলতা বা গিমিক কবি পছন্দ করেন না। ওয়ার্ডসওয়ার্থ যা বলেছিলেন:’Poetry is the first and last of all knowledge — it is as immortal as the heart of man.’ অর্থাৎ কবিতা হলো সমস্ত জ্ঞানের প্রথম এবং শেষ — এটি মানুষের হৃদয়ের মতো অমর। আশিস বরাবর একথাই সমর্থন করেন। হৃদয়ের চিরন্তন আবেগেই তিনি পরিচালিত হন। আর সেই চিরন্তন জ্ঞানকেই কবিতায় প্রয়োগ করেন। ফলে তাঁর কবিতা হৃদয় সঞ্জাত এক মানবিক ক্রিয়ারই ফসল। কাব্যের নাম কবিতায় তিনি উল্লেখ করেছেন:
‘তাইতো তৃষার কাছে বসি নিত্যদিন/ গভীরে গিয়েছ ডুবে যেখানে বিলীন।/ এইতো চেয়েছো নারী কবির চলন/ বেঁচে থাকা কিছু সত্য সহজাত মন।/ যে শব্দের মায়া আছে তাকে নাও কাছে/ পৃথিবীর পায়ে পায়ে আনন্দ যে নাচে।/ এই নিয়ে কাটিয়েছি অজস্র বছর/ চিত্রকল্পে রচিয়াছো কবিতার ঘর।’ যে তৃষ্ণা নিয়ে অনন্তের উত্তাপে তিনি ধাবমান, সেই তৃষ্ণা সম্পূর্ণ মানবিক প্রবৃত্তিরই জাগরণ। অজস্র বছর কাটানো প্রবহমান জন্মান্তরেই আত্মদর্শনের অভিরূপ। জীবনের এই স্বরূপকেই চিত্রকল্পের অমোঘ বাতাবরণে লিপিবদ্ধ করেছেন। কবি বলেছেন:’হৃদয় বেঁধেছো শুধু মরমী খাতায়।’ এই ‘মরমী’ শব্দটা উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থকে মনে করিয়ে দেয়: ‘Fill your paper with the breathings of your heart.’
অর্থাৎ তোমার হৃদয়ের নিঃশ্বাসে তোমার কাগজটি পূর্ণ। ‘হৃদয়ের নিঃশ্বাস’ পরোক্ষে ‘মরমী’ হয়ে ফিরে এসেছে আশিস মিশ্রের কবিতায়।
কাব্যের মোট ৫৬ টি কবিতার মধ্যে বেশ কয়েকটি সনেট লিখেছেন কবি। প্রতিটি সনেটই পূর্ণতা পেয়েছে। আত্মোপলব্ধির বিকিরণে ও গীতল ধারায় উচ্ছল মাধুর্যমণ্ডিত। নির্মাণেও নিখুঁত। কোথাও যৌবনের বাঁধুনি সনেটের শব্দের গাঁথুনিতেও মানবিক প্রশ্রয় পেয়েছে। কবি লিখেছেন: সনেট-শরীরে তাকে ধরে রেখেছিলে।/ মহুয়া-চুম্বনে মেতে দ্বার খুলেছিলে।/ হারিয়ে যাচ্ছিলে খুব বৃষ্টির গভীরে।/ স্নানের মায়ায় ডুবে নিভৃত শরীরে’…. কবিতাগুলি মায়াময় ছবির মতো চোখের সামনে যেমন ভেসে ওঠে, তেমনি উপলব্ধির দরজাও খুলে দেয়। প্রকৃতিও মানব শরীরের রসাভাসে ইঙ্গিতমুখর হয়ে ওঠে। কবি লেখেন:’বিকেলে ভাবছো বৃষ্টি, বিকেলে রেস্তরাঁ/ বন্ধুরা ভিজেছে মনে দূরত্বে মদিরা।/ পান করো ঝর ঝর আনন্দ-রজনী/ বাইরে তুমুল কিছু ভিতরে সজনী।/ কীভাবে ধরবে তাকে বাদল পুরুষ/ বৃষ্টি কি ফরাসি মেয়ে? ভারতীয়? রুশ?’ সব কবিতাগুলিতেই আছে এক ছন্দময় চলন। দুষ্টু-মিষ্টির আবছা আড়াল। আবার গভীর কথাও কবি এই হালকা চালেই বলে দিতে পারেন। কখনও উঠে আসে শরীরী পুস্তক থেকে রতিচক্র, কখনও নাভি ও নদীর গভীরতা থেকে কামনার মাঠ, কখনও চিঠির মতো গুছিয়ে রাখা গোপন জ্বরে ঢাকা পৌরুষত্ব। দাম্পত্য বোঝাতে নিষ্ফল শূন্যতারই ইঙ্গিত দেন:
‘কী খুঁজেছে এতদিন/ কী পেয়েছে মন/ কতটা গভীর কতটা গহীন?’ এক অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই তিনি বাস্তবতাকে স্পর্শ করেছেন যে বাস্তবতার কথা জন কিটস বহু আগেই বলে গেছেন:’Nothing ever becomes real till it is experienced.’ অর্থাৎ সব বাস্তবতাই অভিজ্ঞতার দ্বারা লাভ করতে হয়।কবির ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। মশারির ভাষা, রঙ,ফল,কবি, জগত, বিড়াল-জীবন প্রভৃতি কবিতাগুলি অভিজ্ঞতারই জ্বলন্ত উদাহরণ। চিরাচরিত ধারায় কবিতা লিখলেও কবির কথনরীতি, ছন্দবিন্যাস,কবিতার বিষয়-ভাবনা সবকিছুতেই আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সঞ্জয় মাইতির প্রচ্ছদ এক অনন্য সংযোজন।
সারাদিনের তৃষা: আশিস মিশ্র, মোনালিসা পাবলিশার্স, ২২৫,শ্রীরামপুর (নর্থ), গড়িয়া, কলকাতা-৭০০০৮৪,দাম-১২০ টাকা।
(ছবিতে আশিস মিশ্র ও তাঁর কাব্যগ্রন্থ)

#storyandarticle