উল্কি আঁকা নদীর জলজ এসরাজ ও তার চিরন্তন প্রবাহ — তৈমুর খান

Story and Article
4 min readDec 11, 2021

--

ঊনবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত মার্কিন কবি এমিলি এলিজাবেথ ডিকিনসন লিখেছিলেন:

“If I feel physically as if the top of my head were taken off, I know that is poetry.” ( — Emily Dickinson)

অর্থাৎ আমি যদি শারীরিকভাবে মনে করি যে আমার মাথার উপরের অংশটি খুলে ফেলা হয়েছে, আমি জানি এটি কবিতা। আজ দুটি কাব্যগ্রন্থ হাতে পেয়ে আমার এই কথাটিই মনে হলো। প্রথম কাব্যটি লিখেছেন অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়: ‘জলজ এসরাজ’(অক্টোবর ২০২১) প্লাসেন্টা প্রকাশনী, বগুলা, নদীয়া, মূল্য- ১৮০ টাকা। এবং দ্বিতীয় কাব্যটি লিখেছেন পৃথা চট্টোপাধ্যায় ‘উল্কি আঁকা নদী জল’ (অক্টোবর ২০২১), গীর্বাণ প্রকাশন, কলকাতা- ৬, মূল্য ৭০ টাকা।

আশ্চর্য এইযে, দুটি কাব্যের লেখক-লেখিকা দুজনেই ‘চট্টোপাধ্যায়’, দুজনের কাব্যেই ‘জল’ ভাবনার প্রশ্রয় আছে এবং দুজনের কাব্যই একই সঙ্গে আমার হাতে এসে পৌঁছেছে।

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায় যখন লিখলেন:

“বালি ঝড়ে উড়ে যায় সমুদ্রতট

ঝাউ বনের ভেতর দিয়ে অনেক দূর

কবিতা ভেসে যায় ডিঙি নৌকার মতন

ঢেউ ভাঙা জলে অনন্তের দিকে

কবি তাকিয়ে থাকে, দৃষ্টি ভেঙে যায়

ভিজে যাওয়া বর্ষার মতন”

পৃথা চট্টোপাধ্যায় লিখলেন:

“অন্ধকার গূঢ়তর হলে ঝুপঝুপ শব্দ শুনি

পাড় ভাঙে

কাশবন খোড়ো ঘর ভাঙনের মুখে

সুখ বিন্দু লেগে থাকে উঠোনের ঝরা শিউলিতে”

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের ঝড়, সমুদ্রতট, ঝাউবন, ঢেউ, তাকিয়ে থাকা, ভিজে যাওয়া বিশেষ্য-ক্রিয়াগুলির পরিণতি পৃথা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় ফুটে উঠে: অন্ধকার, ঝুপঝুপ শব্দ, পাড় ভাঙা, কাশবন ও খোড়ো ঘরের ভাঙন এবং ঝরা শিউলিতে। প্রসঙ্গ এবং প্রেক্ষাপট প্রায়ই মিশে যায়।

অরিন্দম চট্টোপাধ্যায়ের অসুস্থতা এবং হাসপাতাল প্রসঙ্গ, বিনিদ্র রাত, আকাশের ঘন কালো মেঘ ও বৃষ্টি, অন্ধকার আর্ত মানুষের স্বর এক বিপন্নতার যাপনকেই মনে পড়ায়। তিনি লিখেছেন:

“গোটা হাসপাতাল জুড়ে….

উড়ে উড়ে যেতাম আর্ত মানুষের কাছে

তাদের উপর নজর রেখে

হাতের পরশ রেখে

এইভাবে বিনিদ্র রাত, দিন, মাস, বছর….”

এই কবিতা পড়ার পর পৃথা চট্টোপাধ্যায়ের ‘আত্মহননের ডায়েরি’ আমাদের কষ্টের সীমানাকে আরও দীর্ঘায়িত করে:

“অসুখের সুখে থাকা নির্ঘুম রাত

বিবর্ণ মুখ মোছে বিদেশি টাওয়েলে

জেগে ওঠে আরো এক বিষাদ সকাল

করুণ চিহ্ন ফেলে রাখে ছেঁড়া পালকে”

দুটি কাব্যের মধ্যেই আছে সময়যাপনের নিবিড় বিষাদ গ্রন্থন যা আত্মগত অস্তিত্বের টানাপোড়েন থেকে উদ্গত ভাষা সামীপ্য। অরিন্দম বলেন:

“হলুদ বর্ণমালাগুলোও কেমন ভাবে

হারিয়ে যায় না-পাওয়ার দেশে

তবু হৃদয় উজাড় করে খুঁজি

এইসব দেখে এক অশ্রুনদী বয়ে চলে

বারবার পাড় ভেঙে এগিয়ে যায়”

এক ভাষাহারা বিপন্ন শব্দবোধ যা ‘হলুদ বর্ণমালা’ হয়ে কবির কাছে ধরা দিয়েছে। কিন্তু এই সব কষ্টের কথা লেখা হয়নি। তা ভেসে গেছে অশ্রু নদীর স্রোতে। কখনও নৌকার প্রতীকে। কখনও মায়াজালের ভ্রান্তিতে। পাড় ভেঙে যাওয়া যেন সভ্যতারই প্রচলিত জীবনধারাকে ধ্বস্ত করা। তাই বারবার কবিতাগুলিতে ফিরে এসেছে মধ্যরাত ও সমুদ্র প্রসঙ্গ, নৈঃশাব্দ্যিক মৃত্যুর দৃশ্য এবং রাষ্ট্রের অমানবিক আচরণের রূপ। যদিও স্বপ্ন-প্রেম এবং হৃদয়ের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে শুভ মুহূর্তের জন্য, তবু তা অনিশ্চয়তায় ডুবে গেছে। ঘুমের মধ্যে হলুদবাড়ি এবং হলুদ ওড়না ফিরে এলেও তা মিলিয়ে গেছে। চুম্বন পরিপূর্ণতা পায়নি তাই কবি বলেছেন “অর্ধেক চুম্বন শেষে একচুল নীরবতা/ জানো মধ্যরাতের অরণ্য”। মোহিনীকে খুঁজতেই দিশেহারা হয়েছেন। হৃদয় জুড়ে একগুচ্ছ শূন্যতা বিরাজ করেছে। জল ভেঙে ভেঙে চলে গেছে বৃষ্টিরাত। কখনো স্মৃতি এসে ঘিরে ধরেছে। কবিও নস্টালজিক হয়েছেন। পিছন ফিরে দেখেছেন ছোটবেলাকে। কিন্তু সবই ধূসর। কৃষ্ণ কালো মেঘে ছেয়ে গেছে জীবন। ‘জল’ প্রতীকেই জীবনের উচ্চারণ, জীবনের বহমানতা এবং জীবনের প্রবাহকে তুলে ধরেছেন। বিখ্যাত শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি বলেছিলেন:

“Water is the driver of nature.”

(- Leonardo Da Vinci)

অরিন্দম যেন বলতে চেয়েছেন একই কথা:

“ষাটটা বছর উপত্যকা জুড়ে

শুধু তো বয়ে যায়নি….

এখনও বয়ে যায় গুচ্ছ গুচ্ছ আবেগ”

সুতরাং জল যে জীবনের ও প্রকৃতির আবেগ শিল্পীর ভাষায় driver তা এখানেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

পৃথা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায়ও এক আত্মগত বিষণ্নতার দেখা পাই যা কখনও জল অশ্রু হয়ে, ভেজা গন্ধ হয়ে, বন্যা হয়ে প্রবল গতি ধারণ করে। নিজস্ব অভিমানকে কবি শুনিয়ে দেন: ‘আগুনের পোশাকটা আবার পরবো ভাবছি’। নারী-জীবনের বেঁচে থাকাকে এক সংগ্রামী জীবন বলেই মনে করেন। তাই তাঁর চোখের আড়ালে অযুত প্রপাত এবং নখাগ্রে বিষ নিয়েই বাঁচতে হয়। এই প্রবাহ থেকেই ‘উল্কি আঁকা নদী জলে’র সূচনা। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই মধ্যবিত্তের হাহাকারকে প্রবাহিত করেন তাঁর শব্দ-নদীতে:

“কিছু শব্দ নদী জলে ব্যবহৃত হয়

ভেঙে যায় ঢেউ

অপটু সকালে

নাবিক তোমার মন

শুয়ে থাকে হেমন্তের আলে।”

এই ‘নদী’ প্রতীকটি জলের সামীপ্য থেকেই ধারণ করে তার অস্তিত্ব এবং গতি। আর সেখানেই মূল উৎস হল জীবন। সময়ের কাছে জীবনই নাবিক। নিসর্গ আলোর ছায়া সম্মোহনে কবি দেখেন ‘মৃদঙ্গ লহরী তোলে সময়ের অবিন্যস্ত সিঁড়ি’। এই সিঁড়ি বেয়ে উঠা যায় না। অসুখী সময়ের প্রলাপ বেড়ে ওঠে। তখন নিজেকে এক ব্যঙ্গের শিকার হতে হয়। তখন কার্নিশ থেকে উড়ে যায় প্রাজ্ঞ পেঁচারাও। সময়ের এপিটাফে কবি মৃত্যুর হাতছানি পান। নির্জন বনের কাছে ফিরে এসে রোমকূপে গাছেদের ভাষায় লিখতে থাকেন বসন্ত। এখানেও সেই নীরবতায় নিজেকে চালিত করা। ভয় বিষাদ আনন্দ যাপনের মধ্য দিয়েই পাখির মতো জীবনকে চালিত করেন। অন্ধকার আকাশে ঘরের জানালা খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বসতিও গড়া হয় না। দুঃখের মোতি ছড়ানো ইছামতী নদীর তীরে কবি পরিত্যক্ত হন। বাতাসে ভেসে যায় চন্দন পিঁড়ির গন্ধ। অবচেতনের ভেতরও মাটি ও বৃষ্টির গন্ধ, চাষি বউয়ের ভেজা হাত, তৃষ্ণার্ত মেঘপালক, অতিমারী দিনের হা-অন্ন দীর্ঘশ্বাস ফিরে ফিরে আসে। বিক্ষিপ্ত চিত্রকল্পের ভেতর কখনও আত্মদ্রোহ, কখনও বিশ্বাসহীনতা, কখনো দৈবঅভিশাপের অভিক্ষেপ ফুটে ওঠে। ভালোবাসাতেও ‘আলোর কুয়াশা’ মিশে যায়। এক সংশয়পীড়িত উপলব্ধি সমগ্র কাব্য জুড়ে বিরাজ করে। তাই শেষ পর্যন্ত কবি বলে দেন:

“শরীরলোলুপ কিছু ঘুণপোকা

ঘোরাফেরা করে

কুরে কুরে খায় জীবনের ঘ্রাণ

মাথার ভিতরে জমে গাণিতিক জাল

হিসাব মিলে না কিছু”

কিছুর-ই হিসাব মেলেনি। জীবন তবু বয়ে গেছে ম্রিয়মাণ জলের স্রোতেই। তবুও আমাদের মনে রাখতে হবে মার্টি রুবিনের কথা:”The waterfall winks at every passerby.” (– Marty Rubin)

অর্থাৎ জলপ্রপাত প্রতিটি পথচারীর দিকেই চোখ মেলে।

#storyandarticle

https://storyandarticle.com

--

--

Story and Article

বাংলা ভাষার সাহিত্য পত্রিকা । যে কোনো সময় লেখা পোস্ট করা যায় । ফেসবুক https://www.facebook.com/storyandarticle পত্রিকার লিঙ্ক https://storyandarticle.com